শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১২:৫৯ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং উপমহাদেশের শান্তি

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এবং উপমহাদেশের শান্তি

জয়ন্ত ঘোষাল:

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে যাবেন এতে আর সাংঘাতিক, ঐতিহাসিক অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণের কী আছে? এ তো হয়েই থাকে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সুমধুর সেই একাত্তর সালের বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের সময় থেকে। আর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কতবার বাংলাদেশে গেছেন আর কতবার যাবেন তার কি কোনো হিসাব আছে? তাই যদি হয়, তাহলে গত ২৮ এপ্রিল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর যখন ঢাকায় গেলেন, তখন সারা উপমহাদেশ শুধু নয়, মার্কিন সংবাদমাধ্যমে পর্যন্ত খবর হলো যে কেন এই সফর? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সফরের আগেই জানিয়েছিলেন যে একটি বিশেষ বার্তা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে, সেই কারণে তিনি আসছেন। কী সেই বার্তা? শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতে আমন্ত্রণ জানানোই কি সেই বার্তা?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরকালে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তখন তিনি তাঁকে দিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

সাধারণত রাষ্ট্রনেতারা যখন একটা দেশে যান তখন সেই দেশের রাষ্ট্রপতি বা সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানান। তারপর সেই দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপতি যত দিন না সেই সার্বভৌম রাষ্ট্রে যাচ্ছেন তত দিন সেই দেশের রাষ্ট্রনায়কের আসার অপেক্ষা করেন। কেননা যত দিন না সেই দেশের রাষ্ট্রনায়ক আসবেন তত দিন এ দেশের রাষ্ট্রনায়ক সেখানে যাবেন না। এমন একটা প্রটোকল দীর্ঘদিন ধরে রক্ষিত হয়। তবে কখনো কখনো যদি জরুরি ঘটনা ঘটে সেটা আলাদা ব্যাপার। যেমন রাজীব গান্ধী যখন মারা গেলেন তখন পাকিস্তান থেকে বেনজির ভুট্টো হঠাৎ চলে এলেন। সেটা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সফরের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে ছিল। কেননা শেষকৃত্যের জন্য তিনি এসেছিলেন। কিন্তু এবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কি শুধু শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানোর বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন, নাকি এর পেছনে ছিল গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক আদান-প্রদান?

 

আসলে একদিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ, আমেরিকার ভারতকে কাছে পাওয়ার প্রচেষ্টা; অন্যদিকে ভারত আপ্রাণ চেষ্টা করছে একটা নিরপেক্ষ সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগোতে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের একজন কূটনীতিক আমাকে বলছিলেন, সম্ভবত এই প্রথম এভাবে ভারত পররাষ্ট্রনীতির রূপায়ণ করছে। অর্থাৎ এটা অন্য কোনো দেশের পররাষ্ট্রনীতি নয়, এটাকে বলা হচ্ছে ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট পররাষ্ট্রনীতি’। অর্থাৎ ভারতের স্বার্থ যেখানে রক্ষিত হবে, সেটাই করতে হবে। অর্থাৎ রাশিয়া যে ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছে সেটাকে সমর্থন করা নয়। কিন্তু তাই বলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘে যে অনাস্থা ভোট হয়েছে এবং যেখানে আমেরিকা চেয়েছে বা ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র চেয়েছে, ভারত নিরপেক্ষ থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে। এতে গোসসা হয়েছে আমেরিকার, সেই গোসসা এখনো কাটেনি।

ভারতের মনে হয়েছে, চীনের সঙ্গে রাশিয়ার যে সম্পর্ক, আফগানিস্তানে ভারতের যে কার্যকলাপ তাতে রাশিয়ার যে সাহায্য এমনকি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা না রেখে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা, চীনের সঙ্গে সম্পর্কটাকে এতটা তিক্ত না করা, যাতে সম্পূর্ণ আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল হতে হয় এই নতুন ভারসাম্যের কূটনীতিতে। তার কারণ চীন কিন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্র। আমেরিকা দেশটা ভৌগোলিকভাবে অনেক দূরে। আর এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জিও স্ট্র্যাটেজিক পজিশন আর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক তাতে অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের তুলনায় বাংলাদেশের গুরুত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশের আর্থিক অগ্রগতিও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। আর সেই কারণে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন যাতে কোনো দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে না পড়ে সেটা দেখার দরকার।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মধুর হলেও যেকোনো মধুর সম্পর্কের মধ্যেও কিন্তু উত্থান ও পতন থাকে। ভারত ও বাংলাদেশেরও যেমন কভিড প্রতিষেধক দেওয়ার বিষয়টা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটা ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল, সেটা ভারত দ্রুত নিষ্পত্তি করেছে। কেননা বাংলাদেশ পয়সা দেওয়া সত্ত্বেও ভারত দ্বিতীয় কিস্তিতে প্রতিষেধক পাঠাতে না পারায় বাংলাদেশকে চীনের প্রতিষেধক নিতে হয়েছে। এর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ভারত এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেটা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়। এটা ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে একটা কালো ছায়া ফেলে। আর ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সেই কালো ছায়ার সুযোগটা সব সময় নেওয়ার জন্য বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতসহ নানা মৌলবাদী গোষ্ঠী অপেক্ষা করে থাকে। শেখ হাসিনার ভারতপ্রীতির অভিযোগ তুলে সমালোচনা করে। এই দুই দেশের যে ডমেস্টিক রাজনীতি তার ঊর্ধ্বে থেকে আজ বিশ্বরাজনীতির জন্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা মধুর হওয়া দরকার। আর সে কারণে ভারত সব সময় বাংলাদেশকে কনফিডেন্টলি নিচ্ছে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার অজিত ডোভাল এসব তথ্য জানাচ্ছেন।

সম্প্রতি বিজেপির পররাষ্ট্র বিভাগের প্রধান বিজয় চৌথাইওয়ালা ঢাকা সফরে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে একটু পরিচয় করিয়ে দিই। তিনি মারাঠি। গুজরাটে বড় হয়েছেন, গুজরাটি ভাষা বলতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আর বিজয় চৌথাইওয়ালার পরিবারকেও নরেন্দ্র মোদি অত্যন্ত ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। বিজয় চৌথাইওয়ালাকে যে দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন তিনি নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে সেটা পালন করছেন। এমনকি ট্রাম্পের সময়ও বিজয় চৌথাইওয়ালা ছিলেন, এখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর বিষয়েও তাঁকে অনেক কাজকর্ম দেওয়া হয়েছে। আর তিনি সেগুলো করছেন। অনেক জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর দূত হিসেবেও তিনি যান। তাঁর সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে আওয়ামী লীগ ও বিজেপির মধ্যে একটা আনুষ্ঠানিক আদান-প্রদান হয়েছে।

বাংলাদেশের অনেকেই ভারত থেকে যান। তাঁরা সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব নন। ভারতের বহু ব্যক্তি বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি হিসেবে ঢাকা সফরে যান। আবার ঢাকা থেকেও অনেকে দিল্লিতে আসেন। কিন্তু কে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করছেন, কে আসলে সরকারের সঙ্গে যুক্ত সেটা সব সময় দুই দেশের সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো জানতে পারে না। বিজয় চৌথাইওয়ালা সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কারণ তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে, সরকারিভাবে গেছেন। আর তিনি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কো-অর্ডিনেট করে গেছেন। কার সঙ্গে দেখা করেছেন, কার সঙ্গে দেখা করেননি, কার সঙ্গে নৈশভোজে অংশ নিয়েছেন, কার সঙ্গে নেননি সবটাই বাংলাদেশ সরকারকে কনফিডেন্সে নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রটোকল মেনেই করেছেন।

এখন একটা জিনিস খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে, জয়শঙ্করের সফরের আগে বিজয় চৌথাইওয়ালার সফরটিও ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই কর্মসূচিগুলো বিভিন্ন স্তর থেকে ঠিক করা হয়েছে। সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা তাঁর অবসর নেওয়ার প্রাক্কালে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে তিনি একজন বিরতিহীন রোলার কোস্টার হিসেবে কাজ করে গেছেন। এটাই তাৎপর্যপূর্ণ। জ্বালানি ও নিরাপত্তার সব দিক দেখে জাতীয় স্বার্থটা ভারত কিভাবে মেইনটেন করছে জয়শঙ্কর সেটা বুঝিয়েছেন। ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে সংযোগ ব্যবস্থা বা কানেক্টিভিটি গড়ে তোলাটা এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেরই খুব গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। কারণ এই  কানেক্টিভিটিটা তৈরি হলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশেরও কমিউনিকেশন অন্য সব দেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। আবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর কানেক্টিভিটি বাড়লে ভারতের অনেক সুবিধা হবে। চট্টগ্রাম বন্দর ভারত ব্যবহার করতে পারবে। দীর্ঘদিন ধরে আলাপ-আলোচনা চলছে।

এবার পররাষ্ট্রসচিব নতুন করে একটা ধাক্কা দিয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির পরবর্তী বৈঠকে এই বিষয়টা আরো চূড়ান্ত রূপ নেবে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, দুই দেশের বাণিজ্য, এমনকি তিস্তার বিষয়টা পর্যন্ত বাংলাদেশ আবার নতুন করে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যেমন কুশিয়ারা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টাও রয়েছে। এসবই এবারের আলাপ-আলোচনায় উঠে এসেছে। ১৯৬৫ সালের পর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। সেটা আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের গম অনেক বেশি যাবে বলে এবার আশা করা যাচ্ছে। কেননা বাংলাদেশকে ভারত জানিয়েছে, এবার গমের উৎপাদন ভারতে যথেষ্ট ভালো হয়েছে। আবার সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেটাও আজ ভারতের কাছে একটা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক সুবিদিত; যদিও ইমরান খান সরে যাওয়ার পর নওয়াজ শরিফের ভাই শাহবাজ শরিফ আবার নতুন করে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ নিয়ে চিঠি চালাচালিও হয়েছে। আর ভারত আলাপ-আলোচনা করবে না, এমনটা নয়। কিন্তু সন্ত্রাস নিয়ে তাদের যে শর্ত সেটা থেকে সরে আসেনি। বাংলাদেশকে ভারত জানাতে চায় তাদের দিক থেকে কী কী ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে, কী হচ্ছে না।

ঈদের দিন রাজস্থানের যোধপুরে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়েছে পরশুরামের উৎসব আর ঈদের মধ্যে একটা সমন্বয়ের অভাবে। প্রায় ৯৭ জন আহত হয়েছে আর অনেক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রাজস্থানের সরকারের সঙ্গেও কেন্দ্র আলাপ-আলোচনা করছে। সুতরাং সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতিতে এই উপমহাদেশে যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে তার চেষ্টা চলছে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দেশ। বাংলাদেশও তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে একইভাবে সুসম্পর্ক রক্ষা করছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ২০ কোটি টাকার ওষুধ পাঠানো সেই দৃষ্টিভঙ্গির সর্বশ্রেষ্ঠ নজির। এই পরিস্থিতিতে জয়শঙ্করের ঢাকা সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সফল হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ভারত ও বাংলাদেশের এখন অনেক বড় যাত্রা বাকি। আর সেই সফরে আগামী দিনে আমরা দেখব কিভাবে দুই দেশের সম্পর্কের অগ্রগতি হয়।

লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877